June 30, 2019

অভিষেক ঘোষ



কবিতা :  কেন লিখব 

কবিতা কী ? কাকে বলে ? কবি উইলিয়ম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন, “Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings: it takes its origin from emotion recollected in tranquility.” তাহলে শক্তিশালী অনুভূতিসমূহের স্বতঃস্ফূর্ত প্লাবন বা ভাবোচ্ছাস-ই কি কবিতা ? বোধহয় অনেকেই এই ধারণায় আস্থা রাখতে চাইবেন । কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চিত কোনোদিনই হওয়া সম্ভব নয় । কারণ তা যদি হতো তাহলে সেই মুহূর্তেই কবিতা লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যেত ! দেহের খাঁচায় যেমন প্রাণপাখিটির আনাগোনা কোন পথে হয়, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না, সৈকতে ঠিক কোন মুহূর্তে সমুদ্রের তালপাকানো ঢেউ ভেঙে পড়বে তা যেমন অনিশ্চিত, যেমন অনিশ্চিত শয্যায় ক্লান্ত দু-চোখের পাতায় ভুম নেমে আসার মুহূর্তটি — তেমনি অনিশ্চিত কবিতার সংজ্ঞানির্ণয় । বাতাসে ভেসে আসা জলরেণু যখন বৃষ্টি হয়ে জলাশয়ে ঝরে পড়ে, তা সাবলীল সুষমায় কখন যেন জলে বিলীন হয়ে যায় । কবিতা-ও তেমনি, অনির্দিষ্ট অনুভূতি অব্যয় হয়ে মিশে যায় অক্ষরের শরীরে, কলমের নাভিমূলে কালি-র স্পর্শ গায়ে মেখে । কবিতা শুধু অক্ষর নয়, শুধু স্বর নয়, শুধু বক্রোক্তি নয়, শুধু ব্যঞ্জনা নয় । আবার কবিতা কেবল রীতি নয়, অনুভূতি নয়, বিষয়বস্তু নয়, প্রকাশভঙ্গি নয় । কোনোটাই নয়, অথচ সবগুলি মিলেই কবিতা । এক একজন কবির সৃষ্টিতে একেকরকম মিশ্রণ বা, কম্পোজিশন থাকে । কিন্তু কেউই কি সঠিক জানেন, কোনটি একেবারে সঠিক ? কতটা অনুভূতির সাথে ঠিক কতটা অক্ষর মিশিয়ে কতটা ব্যঞ্জনার আঁচে পদ্যের হাঁড়ি চড়িয়ে, তাতে কতটা প্রকাশভঙ্গির গোলমরিচ ছড়িয়ে দিলে, তা সঠিক কবিতা হয়ে উঠবে ? আদেও কি এমন কিছু হয় ? নাকি আমরা কেবল চেষ্টাই করতে পারি সাফল্যের স্বপ্ন বুকে নিয়ে, স্বপ্ন সত্যি হলে কবির জন্ম হবে ভেবে !


'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি' — কথাটা বোধহয় সকলেই শুনেছেন । কবিতা লিখবো বলে বসে পড়ে শেষমেষ অনেকেই ছড়া লিখে ফেলেন । কারণ তাঁদের ধারণা চালাক চালাক অন্ত্যমিল মানেই কবিতা ! কিন্তু বিষয়টা তরল বলেই বুদ্ধি বা অনুভূতির কাছে ঐধরনের লেখালেখির কোনো আবেদন থাকে না । অনেক আবার ভাবেন আধুনিক তথা যুগপোযোগী হতে গেলে বাক্যে নয়, মন দিতে হবে শব্দে । শব্দ ব্রহ্ম একথা সত্য তবে খামোকা কঠিন তৎসম শব্দ অথবা, বিদঘুটে উপমা ব্যবহার করলেই কবিতা আধুনিক হয়ে ওঠে না । ছন্দোময় অন্ত্যমিলের দায়ভার বইতে হয় না বলে ইদানিং অনেকেই বেশ হালকা বোধ করেন । হাফরাইমে কবিতা হাঁপাতে থাকে আর কবি-ও ! কেউ কেউ ভাবেন স্মার্ট যৌনগন্ধী শব্দ নিয়ে এলেই জীবনানন্দ বা বিনয় মজুমদার হওয়া যায় ! কিন্তু যায় কি ? তাঁদের সংকট তাঁদের শব্দে বেঁচে আছে । সংকট-ও তো বহুমাত্রিক । কেবল ব্যক্তিগত হলে সেই সংকট তুচ্ছ ও নিষ্প্রাণ । আত্মিক সংকট ইতিহাসচেতনা বা সমাজচেতনায় পরিব্যাপ্ত না হলে তা কিছুতেই বৃহত্তর পাঠকের চেতনাকে স্পর্শ করতে পারবে না । ক্ষণস্থায়ী বুদবুদের মতো শব্দের খেলা অনেক আধুনিক কবিরই একমাত্র সম্বল হয়ে পড়েছে । এটা খানিকটা হতাশারও বটে । আধুনিক গানেও তাই । কথায় কোনো দ্যোতনা নেই, নেই অর্থপূর্ণ গন্তব্যের হদিস — শুধুই চালাকি । ছল করে আর যাই হোক কবি হওয়া যায় না । এমনিতেই কবিতা কেউ পড়েন না, পড়তে চান না । অথচ সকলেই প্রায় বলে থাকেন, “কিছুই বোঝা গেলো না !” এখানেই তো মুশকিল । কবিতা যে মোটেও বোঝার ব্যাপার নয় । বুঝতে গেলেই কবিতা সিসিফাসের নিয়তি-র মতো ঘাড়ের বোঝা হয়ে ওঠে । কবিতা উপলব্ধি করতে হয়, অনুভব করতে হয় । কখনো পাহাড়ী পাকদন্ডীর হদিস দেয়, কখনো শীতের সকালের বিলাসী রোদের মত পায়ের কাছে একফালি উষ্ণতা দেয় । আবার কখনোসখনো কবিতা বৃষ্টিভেজা শহরের বিজ্ঞাপনী নিয়ন আলোর মত জ্বলতে থাকে, কখনো গ্রাম্য মাঠে নদীতীরবর্তী পলিমাটিতে সদ্য গজানো ঘাসের ওপর পা ফেলার তৃপ্তি দেয় । এসব চোখ বুজে অথবা ইন্দ্রিয়ের সমন্বয়ে অনুভব করতে হয় । ধরাযাক, থিও অ্যাঞ্জেলোপুলাস-এর Ulysses' Gaze (১৯৯৭) ছবিটি । সিনেমা-টিতে বেশ কয়েকবার আমরা দেখি নায়ক চরিত্রটি ক্রমাগত ভ্রাম্যমাণ, হন্যে হয়ে সে কিছু খুঁজছে । বেশ কয়েকবার আমরা শুনতে পাই আকাশ-পথে বোমারু বিমান থেকে বোমা পড়ার শব্দ, কিন্তু একবার বোমা পড়তে দেখি না । অথচ চরিত্রগুলি আতঙ্কের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেন চোখেমুখে । তাহলে ? দেখতে পাই না, তার কারণ — এ হলো ইতিহাসের অভিঘাত । প্রতিধ্বনির মতো । অতীতে যা সার্বিক ধ্বংসের কারণ হয়েছে তারই প্রতিধ্বনি পরবর্তী প্রজন্মের কানে এবং চেতনায় এসে ধাক্কা দিচ্ছে । পরিচালকের কাছে সময় নিরবচ্ছিন্ন — অনন্ত অখন্ড সময়ের চেতনা । তাই এক সময়ের ঘটনা ভিন্ন সময়ের অভিযাত্রীর বুকে হিল্লোল জাগাতে পারে । জীবনানন্দ সাধে বলেছিলেন, “হাজার বছর ধ'রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি --- ” রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে’ কবিতার প্রথম অর্ধে বা, বাংলাদেশের প্রণম্য সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাসে এই অখন্ড পরিব্যাপ্ত কালচেতনার হদিস মেলে ।


এবার, শেষ করা যাক । কবিতা লেখা যায় কী করে ? প্রথম কথা, চেষ্টা করে লেখা যায় না । যারা যখনতখন লিখে ফেলেন, তাঁদেরও সাধনা আছে । তাঁরা বেশিরভাগই প্রচুর পড়েছেন । তাই তাঁদের ভঙ্গি-টা সহজাত হয়ে গিয়েছে, আর বাকিটুকু অভ্যাস । শ্বাস প্রশ্বাসের মতোই কবিতা আসে । তাঁরা ভাগ্যবান । তবে খাটুনি-টা আছে । আর যাঁদের ওভাবে আসে না, তাঁদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই । স্বপ্নের মতোই কবিতা আসবে । দেখা দেবে আলোর ঝলকানির মতো, শিহরণ-জাগানো অনুভূতির মতো । হয়তো কিছু শব্দ, একটা বাক্য বা একটা সুনির্দিষ্ট ভাবনা । তারপর দরকার হয় অধ্যাবসায়ের । শব্দ নির্বাচনে দক্ষতা, স্বকীয়তা আর মাত্রাবোধ — এসব তখন খুব জরুরী হয়ে পড়ে । খুব করে না পেয়ে বসলে, সত্যিই কবিতা লেখা উচিত নয় । মাঝারি জিনিস যতো ফেলে দেওয়া যায় কবি ও সাহিত্য — উভয়ের পক্ষেই তত মঙ্গল । সিরিয়ার শিশুদের ক্রন্দন যদি আপনাকে আবিষ্ট করে, তবে অবশ্যই লিখুন । কিন্তু যদি পশ্চিমবঙ্গের বেকারসংকট মিয়ে প্রাণ কাঁদে, দয়া করে কবিতা লিখবেন না । বরং গদ্য লিখুন । কারণ সত্য-কে খুব কাছ থেকে জানা যায় না । সত্য জানতে হলে সময়ের দূরত্ব বা অন্তত মানসিক দূরত্ব প্রয়োজন । নাহলে মরীচিকায় ঘুরে মরতে হয় । সুতরাং কবিতা লিখুন নিখাদ অতৃপ্তি থেকে, লঘু বিচ্ছেদ থেকে নয় । কবিতা লিখুন দায়ভার থেকে, দায়বদ্ধতা থেকে, বিলাস থেকে নয় । হয় শব্দের বালিশে ঠেস দিন নয়তো কঠিন মাটি-তে পা ফেলুন । মাটির মালিন্য গায়ে লাগবে বটে, তবু বিশ্বাস করুন, ওই মালিন্যই পারে আপনার সৃষ্টি-কে গতানুগতিকতার লঘুতা থেকে মুক্তি দিতে । কবিতা হোক ফল্গুধারার মতো, অতর্কিতে এসে ভাসিয়ে দিক সময়ের দুর্গ, স্বর্গীয় আভিজাত্য আনতে না পারুক যেন অন্তত সময় আর মানুষ-কে তা ছুঁয়ে থাকতে পারে ।


______________

No comments:

Post a Comment