June 30, 2019

অভিজিৎ দাসকর্মকার



সম্পাদকের দৃষ্টিতে আজকের কবিতা

আমরা এই তরুন প্রজন্ম নিজেদের কোন দশকের আওতায় ফেলছি না । এই সময় কবিতা লিখতে এসে যা দেখি তাতে কবিতার অনেক উন্নতি হচ্ছে। কবিতার এই বিবর্তন বাংলা সাহিত্যেকে এক নতুন  ধরনের বিশেষ জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার পথকে আরও সুদৃঢ় করছে। এতে আমরা নিজেদের যে শুধু বাঙালি বলে গর্ব বোধই করি তাই নয় তার সাথে আমাদের পরিচিতির জায়গাটাকে আরও ব্যপ্ত করছি নিজেরাই যেকোন দৃশ্যকে যুক্তিপূর্ণ, কাব্যিক এবং আলাদা চিন্তা ধারার মাধ্যমে।

    শ্রীকৃষ্ণকীর্তন,চর্যাপদ, পদাবলীর ধারা বা আবহমান, আধুনিক বা তারও পরে POST MODERNISM, এর মাঝে হাংরি (১৯৬১সালে মলয় রায়চৌধুরী ওসওয়াল্ড স্পেংলার এর লেখা "The Decline of the West" বইটির মূল বক্তব্য থেকে এই আন্দোলনের দর্শন গড়ে তুলেছিলেন। স্পেংলারের মতে কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের সংকরায়ণকে স্বীকৃতি দেওয়া তাঁদের কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল । সেই কারণে ভারতে হাংরি আন্দোলন স্থায়ী হয় নি...  এবং শ্রুতিও ক্ষণস্থায়ী। শ্রুতির প্রসঙ্গে কবি উত্তম দাশ তাঁর ‘হাংরি, শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’ গ্রন্থে শ্রুতি সম্পর্কে কী লিখেছেন, দেখে নেওয়া যাক...

“শ্রুতি লেখকদের প্রধান কাজ প্রকরণগত। বিশ্বের বিভিন্ন আন্দোলন যেমন তাদের শিক্ষিত করেছে নিজের অভ্যন্তরে তাকাতে এবং দেশকাল সময়ের প্রেক্ষিতে অনিবার্য ছিল তা। সেই অবচেতন স্তরের অলৌকিক অনুভূতি লৌকিক ভাষায় প্রকাশ করতে গিয়ে বর্জন করতে হয়েছিল যাবতীয় প্রচলিত পদ্ধতি। শব্দের ধ্বনিগুণকে আবিষ্কার করলেন তাঁরা নতুনভাবে, শব্দের একক অর্থ, স্পষ্ট ও অব্যর্থ। সেই সঙ্গে শব্দের চিত্রগুণ। ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের দুটি রূপ দৃশ্য ও শ্রব্য। শব্দের একটি উপাদান বর্ণ, ধ্বনির সাংকেতিক চিহ্ন। অর্থাৎ একাধারে সাংকেতিক ও দৃশ্যময়। ভাষা প্রচলনের পর থেকে বর্ণের এই দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ অবজ্ঞাত হয়েছে, তাকেই নতুন মূল্যে আবিষ্কার করলেন ‘শ্রুতি’র লেখকরা। শব্দের আর একটি রূপ হলো ধ্বনিগত, উচ্চারণে ধরা পড়ে। শব্দের এই দৃশ্যময় ও ধ্বনিময় রূপকে নবলব্ধ উপলব্ধির প্রকাশক হিসাবে প্রয়োগ, ফলত নতুন দ্যোতনা পেল শব্দ।  শব্দের অর্থগতরূপ দৃশ্য ও ধ্বনিতে উদ্ভাসিত হয়ে অনেক অগম্য বোধের সহায়ক হলো। আবিষ্কৃত হলো ভাষার নতুন মাত্রা।

এটুকু হয়ত বলাই যায়, বাংলা কবিতার অবয়বে যে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন এসেছে,কবিতার পংক্তির ১৪, ১৮ কিংবা ২২ অক্ষরের ঠাসবুনোন থেকে মুক্তি পেয়ে অক্ষরবৃত্তও যে দৃষ্টিনন্দন হয়ে খেলা করছে কবিতায়। কবিতার বহিরঙ্গে যে পরিবর্তন এসেছে, তার জন্য শ্রুতির কবিদের প্রচেষ্টাকে না মানাটা অন্যায় হবে। তার্কিকরা ১৯৬৫ সালের আগে কবিতার চেহারা কেমন ছিল এবং পরবর্তী দু’এক বছরে তা কিভাবে হঠাৎ বদলে গেল ভেবে দেখবেন। বাংলা কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে মনে রেখে শ্রুতির কবিরা যে পথ খুঁজতে চেয়েছিলেন তাকেই হয়ত আরো সুন্দর করে তুলেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা )।

     এক সময় দেখেছি Close ended বা একরৈখিক কবিতার ধরনের সাবলীলতা অনেক কবির মধ্যে। উত্তর আধূনীকতার উপর দাঁড়িয়ে লিখতে লিখতে বারীন ঘোষাল সেই পথ ছেড়ে দিলেও কবি প্রভাত চৌধুরী সেই জায়গায় একভাবে নিজেকে মগ্ন রাখেন। তাঁর লেখা 'সাক্ষাৎকার বা আবার সাক্ষাৎকার ' 'সুন্দরবনের কবিতা' কাব্যগ্রন্থ গুলি পড়লে বুঝি উনি আজ থেকে প্রায় ২১-২৩ বছর আগে কি অসাধারন ভাবনার জায়গায় দাঁড়িয়ে বা কি উন্নত চিন্তাভাবনায় নিজেকে বসিয়ে plot construction করেছেন বহুরৈখিকতা এনেছেন! তার কবিতায় সেই বিষয় গুলোর সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাই। উনি কবিতাকে আজও update এবং ডাইমেনশন দেবার কথা বলেন এবং সাধারণ বিষয়কে অন্যের থেকে আলাদা করে ভাবার কথাও বলেন।

 এখন বাংলা সাহিত্যে আরও ১টি নতুন ধারা এসেছে জিরো  বাউন্ডারি কনসেপ্ট (আফজল আলি) নামে। উত্তর আধুনিকতার পর কোনো কনসেপ্ট সেভাবে আসে নি বা কেউ এই বিষয়টার দিকে আলোকপাতও করেন নি সেভাবে। এই ধারাতে তিনি সমস্ত ধারনকে গ্রহন করেছেন। তবে নতুন কী আছে এতে? নিশ্চয় আছে। উনি কিছু বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন যার মধ্যে প্রথমেই বলেছেন কবিতার মধ্যে জাড্য ধর্ম বা জড়তা কাটানোর বিষয়। কারন একই রকম লিখতে লিখতে কবি সেই গতানুগতিকতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েন। যা তারা লেখার পরিসীমাকে স্ট্যাগনেন্ট করে দেয়। তাই তিনি বলছেন যখনই এমন হবে দাঁড়াও, থামো, বসো, ভাবো, তারপর সামনের প্রাচীরকে ভেঙে নতুন করে এগিয়ে চলো।নতুন ভাবে ভাবো কবিতার দৃশ্যপট। স্ট্রাকচার ভাঙো বারবার। নিজের কবিতায় dimension চেঞ্জ করো।নতুন structure তৈরী করো যা তোমার নিজস্বতা বা signature হবে। কবিতায় hybridization আনার কথার উপর  বারবার জোর  দিয়েছেন। এমনকি উনি বলছেন কবিতাটা শুরু হলো গদ্য রূপে তবে শেষও যে ওভাবেই করতে হবে তা কেনো ছন্দ দিয়েও শেষ করাই যায়। মানে সহজ ভাবে বলতে গেলে কবিতায় এমন কিছু ধরন আনতে পারাই যায় যা কখনো আগে লেখা হয়নি।সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র লেখা। তাতে শব্দের ব্যবহার ও এমন হতেই পারে যে আগের শব্দটির সাথে পরের শব্দটির সামঞ্জস্যতা থাকতেই হবে।মানে শব্দ বা বাক্য গঠনের কোন বাঁধাধরা নিয়ম-নৈতিকতা বা ঔচিত্যবোধকে সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপে আটকে রাখতে হবে। এই যে ইজমটা এলো তা তাকে কবিতার প্রতি ভালবাসা,কবিতার আবদ্ধতা আর সময় করিয়ে নিয়েছেন। কবির কবিতা লেখার  বিভিন্ন স্টাইল দেখেই কখনো প্রতি para বা কখনো কখনো প্রতিটি লাইন এমনকি প্রতিটি শব্দেও Structure ভাঙা দেখেই কিন্তু একটা নতুন ইজম তৈরী হয়।কবিতা কিন্তু কোন ইজমের উপর দাঁড়িয়ে থেকে বা ভর করে লেখা হয় না,কবিতাই ইজম তৈরী করে।

              তবে এখন অনেকে সংকেত দিয়ে কবিতা লেখেন ( রাহুল গাঙ্গুলি)। আমি জানি না এর ভবিষ্যৎ কি? তবে যে সংকেত কে মানুষ হাজার হাজার বছর আগে ছেড়ে দিয়ে এসেছে মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা, গলার স্বর, শব্দ, বাক্য ---তারপর কি আবার সেই পিছন দিকে ফিরে যাবে? আমার মনে হয় না। কারণ এই সংকেত ব্যবহার করে করে যদি অনেক কিছু বলাকে সংক্ষিপ্ত করণ করতে চাইছি তাতে তো অসুবিধা। মানে কবিতাটি লিখে তার বর্ণনা করার দায়িত্বও রয়ে যাচ্ছে।কারন এমন তো না আমি লিখছি,পাঠক বুঝুক আমার দায়িত্ব নেই বলে হাত পা ঝেড়ে বসে থাকাও দায়।

কী জানি!! হয়তো আগামীরও পরের কোনো প্রজন্ম বুঝবে।

কবিতায় সহজবোধ্যতা, মনন আর একটু মেধা থাকতেই হবে। এই মেধাই বোধ হয় অন্য কবির থেকে নিজেকে আলাদা করতে বা নিজস্বতা তৈরী করতে সাহায্য করবে।

আমার ভাবনাটুকু শেয়ার করলাম। রাগ রোষ তৈরী করা বা নিজের ঢাক পেটানোর উদ্দেশ্য কিছু নেই।

ভালো থাকুন। কবিতায় থাকুন....

                               (সম্পাদক : সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল)
                        _____________________

No comments:

Post a Comment